মঙ্গলবার ● ১৬ আগস্ট ২০২২
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » সোনালী চাকমা কি ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ ও অভাবের চিত্র
সোনালী চাকমা কি ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ ও অভাবের চিত্র
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ, অভাব ও সাম্প্রদায়িকতা কি তা খাগড়াছড়িতে গত ১১ আগষ্ট-২০২২ (বৃহস্পতিবার) মা সোনালী চাকমা ওরফে রুপালী নিজের গর্ভের সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমাকে বাজারে বিক্রয় করতে এনে তা আবার কোটি মানুষের সামনে নিয়ে আসলেন।
প্রয়াত দাদু পন্ডিত সুরেদ্র লাল বড়ুয়ার মুখে শুনেছি ১৯৪২-১৯৪৪ সালে ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ, অভাব ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। আর যারা বেঁচে ছিলেন তাদের মধ্যে ভাতের জাউও খাওয়ার জন্য তৎকালিন জমিদার আর ইংরেজদের কাছে বাবা-মায়েরা নিজের সন্তানকে ক্রীতদাশ হিসাবে বাজারে বিক্রয় করে দিতেন।
দাদু পন্ডিত সুরেদ্র লাল বড়য়ার মুখের কথার সত্যতা পাওয়া যায়।
দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৩ সাধারণত পঞ্চাশের মন্বন্তর (বাংলা ১৩৫০ সালে) হিসেবে পরিচিত গুরুতর দুর্যোগ। এতে প্রদেশের প্রায় সাত লক্ষ পরিবারের অথবা ৩৮ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদার লক্ষণীয় অবনতি ঘটে। এর কারণ হলো, তারা তাদের যাবতীয় সম্পত্তি তথা ভূমি, লাঙল, গবাদিপশু, গহনা, বাসন-কোসন, যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সামগ্রী বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং এভাবে সাড়ে তিন লক্ষ পরিবার চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হয়। এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটি হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় যে, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালব্যাপী দুর্ভিক্ষে এবং এর ফলে সৃষ্ট মহামারিতে ৩৫ থেকে ৩৮ লক্ষ লোক মারা যায়। এ মৃত্যুর হার ছিল স্বাভাবিক মৃত্যুর হারের চেয়ে বেশি। প্রকৃত পক্ষে, এ উপমহাদেশের যে কোনো অংশে ১৭৭০ সালের পর যেসব দুর্ভিক্ষ আঘাত হানে তার মধ্যে এটি ছিল চরমতম।
দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিশনের মতামত অনুসরণ করে ১৯৪২ সালের প্রথমদিকে বার্মার পতনের পর থেকে যে সকল কারণ ও ঘটনা পরম্পরা এ দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী তা আলোচনা করা যেতে পারে। কৃষিজাত পণ্যের মূল্য, বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্রমবর্ধমান খাদ্যশস্যের মূল্য এ সময়ে আরও বেড়ে যায়। এর পিছনে চারটি কারণ ছিল। প্রথমত, প্রদেশে জাপানি আক্রমণ আসন্ন বলে চতুর্দিকে ভীতি ছিল এবং বৃহৎ এলাকাব্যাপী অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল। ফলস্বরূপ, কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যাদি বিক্রি করতে সতর্কতা অবলম্বন করে। একই সময়ে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধির দাবি বাড়তে থাকে; কারণ অব্যাহত সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ভোক্তাগণ অধিকতর ক্রয় করতে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, জাপান যুদ্ধ ঘোষণা করার পর সরকার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে জনগণকে দুমাসের খাদ্য মজুত রাখতে নির্দেশ দেয়। দ্বিতীয়, বার্মা থেকে চালের আমদানি বন্ধ হয়ে যায় এবং একই সময় ভারতের অন্যান্য প্রদেশে, যেগুলি বার্মা থেকে আমদানির উপর নির্ভর করত, চালের রপ্তানি বেড়ে যায়। তৃতীয়, জাপানি আক্রমণের ঝুঁকি সামরিক কর্তৃপক্ষকে ১৯৪২ সালের প্রথমদিকে দুটি ব্যবস্থাসম্বলিত ‘প্রত্যাহার’ নীতি কার্যকরী করতে বাধ্য করে। একটি ছিল ফসলবছর শেষ হওয়া পর্যন্ত সমুদ্র তীরবর্তী মেদিনীপুর, বাকেরগঞ্জ ও খুলনা জেলায় স্থানীয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে চাল ও ধান আছে বলে হিসাব করা হয়েছিল তা সরিয়ে নেওয়া। অন্য সিদ্ধান্তটি অনুযায়ী, ১০ জন অথবা তার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে সক্ষম এ রকম নৌকা সহজে আক্রান্ত হতে পারে বিবেচনা করে সমুদ্রতীরবর্তী জেলাসমূহ থেকে সেগুলি প্রত্যাহার করা। চতুর্থত, বার্মার পতন বাংলাকে যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটে নিয়ে আসে; ফলে প্রদেশে অভূতপূর্ব মাত্রায় সামরিক ও বেসামরিক নির্মাণকাজ শুর হয়। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ এসে পড়ে, কারণ যুদ্ধের খরচ মেটাতে সরকার নোট মুদ্রণের আশ্রয় নেয়।
জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কথা চিন্তা করে সরকার হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয় এবং জুন মাসে (১৯৪২) কলকাতার বাজারে মোটা ও মাঝারি চালের সংবিধিবদ্ধ সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দিয়ে আদেশ জারি করে। অনতিবিলম্বে কলকাতা ও অনেকগুলি জেলা থেকে সরবরাহ অদৃশ্য হয়ে যায়। এ সময়ে ‘প্রত্যাহার’ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে যে মজুত তৈরি হয়, তা অত্যন্ত উপকারী প্রমাণিত হয়। এ মজুতসমূহের একটি অংশ কলকাতায় চালান করা হয় এবং তা বিতরণ করা হয়: (ক) নিয়ন্ত্রিত দোকানের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মধ্যে, (খ) শিল্প-কারখানার মালিকদের মাধ্যমে, যারা নিজেদের ক্রয় পদ্ধতি ও খাদ্যশস্যের দোকান সংগঠিত করছিল এবং (গ) কলকাতা পৌরসভার মাধ্যমে। অতি শীঘ্র সংবিধি অনুযায়ী মূল্য সীমা বেঁধে দেয়ার নির্দেশের অকার্যকারিতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুতরাং জেলা কর্মতাদের নির্দেশ দেওয়া হয় যে আপদকালের সুযোগ নিয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্র ব্যতিরেকে তারা যেন দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার চেষ্টা না করেন। ভারতের অন্যান্য প্রদেশে রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞাসহ এ সিদ্ধান্তটি পরিস্থিতির কিছুটা স্বস্তিবিধান করে এবং সরবরাহ ও মূল্য আবার কিছুটা ভারসাম্য অবস্থায় ফিরে আসে।
কিন্তু অতি শীঘ্র পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। অক্টোবর মাসে উপকূলীয় জেলাসমূহে ৩২০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে প্রচান্ড ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। যার ফলে ক্ষেতের আমন ধানের বিপুল ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের পর ফসলে রোগের আক্রমণ শুরু হয় এবং এর পরিণতিস্বরূপ ১৯৪২ সালের শেষ দিকে আমন ধানের সংগ্রহে ঘাটতি পড়ে। এর ফলে সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাসে যে মূল্যবৃদ্ধি প্রতিহত করা হয়ে ছিল তা আরেকবার নতুন গতি লাভ করে। ২০, ২২ ও ২৪ ডিসেম্বর কলকাতায় বিমানযোগে আক্রমণ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে সঙ্ঘটিত হয় এবং ফলে বেশ কিছু খাদ্যশস্যের দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। এরূপ অবস্থায় সরকার নগরের মজুতসমূহ নিজ দখলে নিয়ে আসার এবং সেগুলিকে নিয়ন্ত্রিত দোকান ও ‘অনুমোদিত’ বাজারের মাধ্যমে পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। কলকাতায় মজুতসমূহ নিজ দখলে নিয়ে আসতে বাধ্য হবার পর সরকারকে এখন সরবরাহ বজায় রাখতে হয়। সরকার যে পরিমাণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে মনস্থ করেছিল, বিমান আক্রমণের পর নতুন করে তার চেয়েও ব্যাপক আকারে সংগ্রহ অভিযান চালু করতে বাধ্য হয়। এ উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে সাতজন এজেন্ট বাছাই করা হয় এবং সর্বোচ্চ ক্রয়মূল্য ধার্য করে দেওয়া হয়। কিন্তু এর ফলাফল সন্তোষজনক হয়নি; পরিণতিস্বরূপ সংগ্রহ অভিযান পরিত্যক্ত হয় এবং ধান ও চালের নির্ধারিত মূল্যসীমাও তুলে নেওয়া হয়। কলকাতায় তখন সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু একই সময় মূল্যসীমায় ও আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। কলকাতায় মোটা চালের দাম ১৯৪৩ সালের ৩ মার্চ তারিখের প্রতিমণ ১৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ মে তা প্রায় ৩১ টাকায় দাঁডায়। কিন্তু ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় প্রতিমণ চাল ৬ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছিল। সঙ্কট বিস্তার লাভ করায় কোনো কোনো জেলায় প্রতিমণ চাল ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হয়।
চালের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য অংশত দায়ী ছিল খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি এবং তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মানুষের অন্যান্য কারসাজি। ঘাটতির পিছনে যে বিষয়টি কাজ করেছে তা হলো নভেম্বর/ ডিসেম্বর মাসে (১৯৪২) আমন ধানের স্বল্প উৎপাদন এবং বার্মা থেকে চাল আমদানি না করা। দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিশনের অভিমত ছিল যে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালে জের টানা পুরানো চালের মজুতে কমতি ছিল। এ কমিশনের মত অনুযায়ী, প্রায় তিন সপ্তাহের (অর্থাৎ শতকরা প্রায় ছয় ভাগ) প্রয়োজনীয় চালের সরবরাহে ঘাটতি ছিল। তবে ঘাটতি এমন অধিক ছিল না যে, দ্রব্যমূল্যের এতটা ঊর্ধ্বগতি অথবা এ কারণে পরবর্তীসময়ে যে অনাহার ও মৃত্যু ঘটে তাকে যুক্তিসঙ্গত প্রতিপন্ন করতে পারে। অন্যভাবে বলতে গেলে, চালের মূল্যবৃদ্ধি ছিল একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রকৃতপক্ষে, যেভাবে পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, শুরু থেকে (১৯৪২ সালে) সরবরাহের অবস্থা চিন্তা করলে মূল্যবৃদ্ধি ন্যায় সঙ্গত ছিল না। কারণ, বার্মা থেকে আমদানি ও ভারতের অন্যান্য প্রদেশে রপ্তানি বাংলার মোট উৎপাদনের বৃহৎ অংশ গঠন করত না। কিন্তু অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মূল্য বৃদ্ধি পায়, কারণ উৎপাদনকারীরা তাদের নিকট থাকা উদ্বৃত্তের পুরোটা পরে অধিক মূল্য পাওয়ার প্রত্যাশায় অথবা ভয়ে বাজারে বিক্রি করতে অনিচ্ছুক ছিল, ভোক্তাগণ তাদের বর্তমান প্রয়োজনের চেয়ে অধিক ক্রয় প্রবণ হয়ে উঠেছিল এবং ব্যবসায়ীরা ফটকামূলক কেনা ও গোপন-মজুতের আশ্রয় নিয়েছিল। পশ্চিমের জেলাসমূহে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়, আমন ধানের নিম্ন ফলন, কলকাতার উপর বিমান আক্রমণ, বার্মা থেকে আগত উদ্বাস্তদের ঢল, চাল সংগ্রহ এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাসমূহ পরিত্যক্ত হলে উৎপাদনকারী, ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের এ ধরনের প প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। লোভ ও ভীতির যে পরিবেশ বিরাজ করছিল তা সমপ্রতিক্রিয়াধারাকে উসকে দেয়। এটি মূল্য-স্তরকে এত উচ্চে নিয়ে যায় যে তা অনুৎপাদনকারী গরিব শ্রেণির বৃহৎ সংখ্যক জনগণ (যাদের মধ্যে কৃষিকার্যে নিয়োজিত শ্রমিকরা অন্তর্ভুক্ত) এবং এক শ্রেণির চাষি যারা তাদের নিজেদের প্রয়োজন মিটানোর মতো যথেষ্ট পরিমাণ উৎপাদন করত না তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। প্রসঙ্গক্রমে, উনিশ শ ত্রিশের দশকের শেষ দিকে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ চাষি পরিবারপিছু দুই একরের কম পরিমাণ জমির মালিক ছিল এবং গ্রামীণ জনসংখ্যার শতকরা প্রায় আট ভাগ ছিল কৃষিকার্যে নিয়োজিত শ্রমিক। অধিকন্তু, বিভিন্ন কারিগরি শিল্প, মাছ ধরা, ধান ভানা এবং অনুরূপ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত লোকজনের বেশ কিছুসংখ্যকও ছিল গরিব। এভাবে, স্বাভাবিক সময় ও গরিব শ্রেণির বেশ কিছু লোক জীবনধারণের জন্য যতটুকু না হলেই নয় ততটুকু খেয়েই বেঁচে থাকত, কারণ তারা যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করতে পারত না এবং তাদের যতটুকু খাদ্য প্রয়োজন তা ক্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থও তারা উপার্জন করত না। তাদের জন্য অনাহার ও জীবনধারণের জন্য নিম্নতম খাদ্যসংগ্রহের মধ্যকার ভারসাম্য এত সূক্ষ্ম ছিল যে মূল্য ও খাদ্য সরবরাহের মধ্যে সামান্য তারতম্য ঘটলে তা তাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল এবং তাদের অনাহার ও মৃত্যু ঘটাতে পারত। এটাই ছিল ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভাগ্যপূর্ণ অবস্থার চিত্র।
(তথ্য সূত্র : বাংলা পিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞান কোষ)।
২০২০, ২০২১-২০২২ সালে বাংলাদেশ :
পৃথিবীব্যাপী কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে ২০২১ সাল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি ঘটনাবহুল বছর ছিল। ২০২০ সালের শুরুর দিক থেকে শুরু হওয়া অতিমারির প্রথম ঢেউ বাংলাদেশে খুব বেশি আঘাত হানতে না পারলেও ২০২১ সালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেশ বিপর্যস্ত হয় পড়ে ছিল। প্রতিদিনের সংক্রমণের হার প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছে যায় এবং মৃত্যু ২শত জনের উপরে পৌঁছে যায়। দেশব্যাপী জনগণের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক শুরু হয়। এই অবস্থার তিন-চার মাস চললেও সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টার কারণে সংক্রমের হার আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে এবং বছরের শেষের দিকে সংক্রমণ যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসে। পরবর্তী সময়ে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে চলে আসে। সংক্রমণের হার ১ থেকে ২ এক শতাংশের মধ্যে চলে আসে এবং মৃত্যুহারও এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়।
কোভিড-১৯ অতিমারির আতঙ্কের মধ্যে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকার বিষয়টি উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছিল। তবে সরকারের সহায়তায় জনগণ সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে লকডাউনের সময় সহায়তা প্রদান করেন। তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০২১ সালের শুরুর দিক থেকে টিকা প্রদানের সরকারি কার্যক্রম দেশ এবং দেশের বাইরে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়। যেখানে অনেক উন্নত দেশ তাদের জনগণের জন্য টিকা ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ইতোমধ্যেই টিকার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। তের কোটির উপরে মানুষ টিকার এক ডোজ ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ টিকার দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেছে। অতি সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত গাইডলাইন অনুযায়ী সরকার টিকার দ্বিতীয় ও ৩য় ডোজ প্রাপ্ত ষাটোর্ধ্ব জনগোষ্ঠী এবং সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের বুস্টার ডোজ প্রদান শুরু করছে যেটি একটি অনন্য অর্জন ।
কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ স্বাস্থ্য খাতকে বিপর্যন্ত করলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন চলমান ছিল। যখন করোনাকালে পৃথিবীর বড় বড় দেশের জিডিপির অর্জন তিন শতাংশের নিচে নেমে আসে, সেই সময় বাংলাদেশের জিডিপির অর্জন ছিল ৬ শতাংশের ওপরে। বিশেজ্ঞদের ধারণা ছিলো, এ বছরে জিডিপির অর্জন ছিল প্রায় ৭ শতাংশের কাছাকাছি হবে। কিন্তু বস্তবে তা হয়নি। করোনার প্রভাব চলমান থাকলেও বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। পদ্মা সেতু চালু করা হয়েছে সেতুতে রেল চলাচলের কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। ঢাকা মেট্রো রেলের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এছাড়া অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে।
বলতে গেলে বাংলাদেশে করোনার প্রভাব, অতিমাত্রায় দলীয় করণ ও বাকিটা দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি বেসামাল হয়ে পড়ে।
তার মধ্যে নতুন সমস্যা দেখা দেয় রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধ।
রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে। এই আক্রমণটিকে আন্তর্জাতিকভাবে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করে, ৮.৮ মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে, এবং আরও লক্ষাধিক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়।
বাংলাদেশে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাস পর্যন্ত কোন রকম ভাবে অর্থনীতির চাকা সচল ছিলো।
২০২২ সালের জুন, জুলাই ও আগষ্ট মাসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে, দেশের মুল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানীতে নেমে আসে।
দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়তে থাকে, হঠাত করে ৫ আগষ্ট শুক্রবার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। নতুন দাম কার্যকর হয় শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার পর ৬ আগস্ট থেকে।
ভোক্তা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
শুক্রবার ৫ আগস্ট রাত ১০টায় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য পরিস্কার করা হয়।
সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সাথে সাথে দেশের মানুষের মধ্যে শুরু হয় উৎকন্ঠা দেখা দেয়।
কাঁচা মরিচ প্রতিকেজি ৪-৫শত, টমেটো কেজি ২শত-২৪০, মোটা চাউল প্রতি কেজি ৭০, আলু প্রতি কেজি ৪০, পেয়াজ প্রতি কেজি ৫০, ১টি সিঙ্গারার দাম ১০, ১টি পরাটার দাম ১০, গোল মরিচ কেজি ১ হাজার, ডিম প্রতি ডজন ১৬০, ভাল চাউল প্রতি কেজি ১৩০, ব্রয়লার মুরগী প্রতি কেজি ২২০ টাকা।
অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায় নিত্য পণ্যের দাম। সকল সেক্টরে মানুষের আয় না বাড়লেও বেড়েছে ব্যয়ের খাত। দেশের ৭৫% মানুষ সংকটে পড়েছে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ভাইবোনছড়ার ১ নং ওয়ার্ডের পাকোজ্জাছড়ি গ্রামের বাসিন্দা সোনালী চাকমা ওরফে রুপালী তার ৬ বছরের সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমাকে সাথে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে তাদের মা-ছেলের সংসার চালায় কিন্তু ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ ও অভাবের কারণে নিজের গর্ভের সন্তানকে বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে আসলেন মা। কেউ কেউ বলছেন দত্তক দেয়ার জন্য বাজারে সন্তানকে নিয়ে আসেন মা। সন্তানকে দত্তক দিয়ে টাকা চাওয়া আর বিক্রয় করার মধ্যে পার্থক্য দেখিনা। যে লোক বা পরিবার দত্তক নিবে সেই লোক সোনালী চাকমাকে ১২ হাজার টাকা দিতে হবে। বিষয়টি কি দাঁড়ায়!
সোনালী চাকমা তার নিজের ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ ও অভাব দুর জন্য সন্তানের বিনিময়ে ১২ হাজার টাকা দাবি করেন। সোনালী চাকমা তো নেশা করার জন্য অথবা স্বর্ণের গহনা কেনার জন্য ৬ বছরের সন্তানকে বিনিময় করতে চায়নি।
কেউ কেউ আবার বর্তমান সময়ে যে দেশে নিরব দুর্ভিক্ষ ও অভাব চলছে তা আড়াল করতে সোনালী চাকমা ও তার সন্তানের বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মাঠে নেমেছে। না-কি আরেকটা দুর্ভিক্ষের কথা জাতি জেনে যাবে এজন্য আড়াল করার প্রচেষ্টা। মানুষের মধ্যে চিন্তা-চেতনার ভিন্নতা থাকবে এটা স্বাভাবিক চলমান প্রক্রিয়া।
সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমার দাম নির্ধারন করে ১২ হাজার টাকা। অনলাইন গণমাধ্যমে কথাটি শুনে মানুষ হতভাগ হয়ে পড়ে হৃদয়বিদারক এঘটনা।
বাজারে কেউ একজন ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেলেটি নিতে চান।
পরবর্তীতে কমলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারম্যান সুনীল চাকমার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা পরিস্থিতি সামাল দিতে রামকৃষ্ণ চাকমাকে তাদের দ্বায়িত্বে নেন।
এর পরের দিন সত্যি মানবতার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা এমপি।
অভাবের কারণে বাজারে নিজের সন্তান বিক্রির খবর পেয়ে বাসন্তী চাকমা এমপি নিজে পাকোজ্জাছড়ি গ্রামে সোনালী চাকমা বাড়িতে গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নেন। এমপি বাসন্তী চাকমা সোনালী চাকমা ও তার ৬ বছর বয়সী সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমার জন্য তাৎক্ষনিক সরকারি ত্রান তহবিল থেকে ৬ মাসের খাদ্য ও নগদ টাকা দিয়ে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া ১টি সরকারি অনুদানে ঘর করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তার পাশাপাশি শিশু রামকৃষ্ণ চাকমাকে সরকারি শিশু সদনে ভর্তি করে আশ্বাস এমপি বাসন্তী চাকমা।
এখানে উল্লেখ্য, সোনালী চাকমার থাকার জন্য ১টি ঘর নাই, সে তার সন্তানকে নিয়ে থাকে গোয়াল ঘরে, সোনালী চাকমা ও তার সন্তানের ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ ও অভাব নিজ চোখে দেখে এমপি বাসন্তী চাকমা সরকারি ত্রান ও সরকারি ঘর দেয়া আশ্বাস দিয়েছেন।
ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ ও অভাব তাড়নায় সোনালী চাকমা সাহস করে বাজারে গিয়ে সন্তান বিক্রয়ে চেষ্টা করেছেন। বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সুযোগ নাই। সোনালী চাকমা ওরফে রুপালি চাকমা ও তার সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমার সংবাদটি কোন গুজব বা বানোয়াট নয় এটা পরিস্কার।
সোনালী চাকমার ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ ও অভাবের কথা জানার পর খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন সাহায্যের অংশ হিসেবে সোনালি চাকমাকে ভূমিসহ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর প্রদান, তার মাসিক আয়ের উৎস হিসেবে এক লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র করে দেওয়া হয়। সোনালি চাকমার ছেলে রামকৃষ্ণ চাকমাকে খাগড়ছড়ি সদরের সরকারি শিশু সদনে ভর্তি করার পাশাপাশি সোনালি চাকমার চিকিৎসা এবং তাকে একটি সরকারি ভাতার আওতায় নিয়ে আসার কাজ শুরু করেন।
খাগড়ছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেছে, ‘সোনালি চাকমা খুবই অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। তার এই অসহায়ত্বের সময় যথাসাধ্য চেষ্টা করে আমরা তার পাশে দাঁড়িয়েছি। সোনালি চাকমার ভবিষ্যতের পাশাপাশি তার ছেলের দায়িত্ব জেলা প্রশাসন নিয়েছে।
এছাড়াও সোনালী চাকমা এবং রামকৃষ্ণ চাকমাকে স্থানীয় চেয়ারম্যান তাদের ঘরে হাড়ি-পাতিল কিনে দিয়েছেন। প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হৃদয়বান ব্যক্তিরা সোনালী চাকমা ও রামকৃষ্ণ চাকমাকে সাহায্য সহায়তা দিচ্ছেন। তা ভালো সংবাদ। কিন্তু খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সোনালী চাকমা কি আরেকটা ২০২২ সালে ক্ষুধা, দরিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ ও অভাবের চিত্র?
লেখক : নির্মল বড়ুয়া মিলন
স্টাফ রিপোর্টার
দৈনিক গণকণ্ঠ
১৬ আগষ্ট-২০২২ ইংরেজি।