সোমবার ● ৭ অক্টোবর ২০২৪
প্রথম পাতা » ছবি গ্যালারী » বাঙালি বিদ্বেষী বিতর্কিত দেবাশীষ রায় সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য
বাঙালি বিদ্বেষী বিতর্কিত দেবাশীষ রায় সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য
অনলাইন ডেক্স :: পিতা ছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। ছিলেন এক বাংলাদেশ, এক রাষ্ট্র গঠনের বিরোধী। লাল সবুজের মানচিত্র মেনে নিতে পারেননি। আর তাই গোপনে পাকিস্তানের সামরিক শাসন এবং বেসামরিক আমলাদের সাথে গড়ে তোলেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। উদ্দেশ্য একটাই-পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা স্বায়ত্তশাসন।
আলোচিত-সমালোচিত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের এমন ভূমিকার পর এবার আলোচনায় তার সন্তান দেবাশীষ রায়। গত ৬ অক্টোবর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হল আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক কোর কমিটির সভা।
এতে জানানো হয়, বিতর্কিত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের ছেলে চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়কে সংবিধান সংস্কার কমিশনে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। সভার একপর্যায়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান সবাইকে জানান, চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়কে সংবিধান সংস্কার কমিশনে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আর তার এই ঘোষণার পরপরই প্রশ্ন উঠেছে-স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধীতাকারী পরিবারের সন্তান হিসেবে দেবাশীষ রায় সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য হতে পারেন কি না। ৬ অক্টোবর খবরটি চাউর হওয়ার পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সব গোষ্ঠীর লোকদের মাঝে এই নিয়ে দেখা গেছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই নিয়ে নানা কথা লিখেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দারা। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সমালোচিত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় চাকমা জাতিগোষ্ঠীকে বাঙ্গালিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতে পরিণত করেছিল।
সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়েছিলেন সেই পাকিস্তান আমলে। প্রকাশ্যে বাংলাদেশের বিরোধীতাকারী এমন একজন ব্যক্তির সন্তানও পরবর্তীতে ছিলেন দেশের নানা স্বার্থের বিপক্ষে। আর তাকেই কেনো স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ এমন বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য সদস্য করা হলো?
বাবার যত বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
লন্ডন-ভিত্তিক ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জীত দেবসরকার, ‘দ্য লাস্ট রাজা অফ ওয়েস্ট পাকিস্তান’ নামের একটি বই প্রকাশ করেছেন ২০১৫ সালে। সেখানে তিনি সমালোচিত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় চাকমাকে আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিক হিসেবে তুলে ধরেছেন।
তিনি লিখেছেন, নিজের রাজত্ব এবং স্বায়ত্তশাসন টিকিয়ে রাখতেই ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। উনি চাইছিলেন তাঁর রাজত্ব। রাজ পরিবারের শাসন যেন বজায় থাকে। যদিও অনেক সাধারণ চাকমা তাঁর নীতির বিপক্ষে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মানে অনেক চাকমা ত্রিদিব রায়ের এমন সিদ্ধান্তের ছিলেন ঘোরবিরোধী। তারা সবাই চেয়েছিলেন তিনি চাকমাদের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে ঘটেছে এর উল্টো।
আর তার এই স্বার্থপর সিদ্ধান্তের কারণে পুরো চাকমা গোষ্ঠী স্বাধীন বাংলাদেশে থেকে গেছেন এখন বাঁকা চোখে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পূর্ব পাকিস্তানের উদীয়মান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা স্থানীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকে পাত্তা দেননি চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরেও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মত পাল্টাননি তিনি। (বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন/২০১৫)
রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জীত দেবসরকার, ‘দ্য লাস্ট রাজা অফ ওয়েস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে এই সমালোচিত রাজা সম্পর্কে আরও লিখেছেন, ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পছন্দের মানুষ ছিলেন। উনি সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাদেরকে অনেক উন্নত মানের বাহিনী মনে করতেন।
বাংলাদেশের বিরোধীতাকারী দেবাশীষ রায়ের পিতা রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পান। না, এখানেই থেমে থাকেনি সবকিছু। পেয়েছেন বিরোধীতা করার আরও নানা পুরস্কার। পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের প্রধান হয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রাপ্তির আবেদনের বিরোধিতা করেন এই বিতর্কিত ব্যক্তি। এর আগে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের কারণে পাকিস্তান সরকার তাকে আজীবনের জন্য ফেডারেল মন্ত্রী ঘোষণা করে। যা নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠে ওই সময়ে।
এখনও ক্ষুব্ধ পাহাড়ের মানুষ
চাকমাদের ৫০তম রাজা পাকিস্তানপন্থী ত্রিদিব রায়-এর নাম ১৯৭২ সালের দালাল আইনে অভিযুক্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি সেই অভিযোগ মোকাবেলা করার জন্য কখনো বাংলাদেশে ফিরে আসেননি। সারাজীবন পাকিস্তানের পক্ষে থাকা এই ব্যক্তি ৭৯ বছর বয়সে ২০১২ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে রয়ে করেছেন। (দ্য লাস্ট রাজা অফ ওয়েস্ট পাকিস্তান, ১৬১ পৃষ্ঠা। প্রকাশক: কুইনটাস।)
বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে এভাবে দীর্ঘকাল তাঁর পড়ে থাকায় সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সর্বত্র। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য দেবাশীষ রায়ের পিতা রাজা ত্রিদিব রায়ের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে এখনও ক্ষুব্ধ পাহাড়ের মানুষ। ২০১৭ সালে বিতর্কিত এই ব্যক্তির নামে পাহাড়ে তৈরি করা সমস্ত স্থাপনা থেকে নাম সরিয়ে ফেলারও একবার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
রাঙামাটির একজন আবেদনকারী মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রিট করেন। সেই রিটের প্রেক্ষিতে তৎকালীন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস ৯০ দিনের মধ্যে সকল স্থাপনা থেকে ত্রিদিব রায়ের নাম সরিয়ে ফেলার আদেশ দেন।
ত্রিদিব রায়ের নামে খাগড়াছড়িতে ত্রিদিবনগর, ত্রিদিবনগর সড়ক, ত্রিদিবনগর হাইস্কুল রয়েছে। এসব স্থাপনা থেকে তার নাম মুছে ফেলার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। রাঙামাটির বনরূপায় বসবাসকারী স্থানীয় পাহাড়ি বাসিন্দা সুনীল বড়ুয়া বলেন, এই একটি লোকের জন্য এখনও একটি জনগোষ্ঠী সবার কাছে করুণার পাত্র হয়ে আছে। কবে এই দুর্নাম থেকে রক্ষা পাবে তা কেউ বলতে পারবে না।
আরেক বাঙালি বাসিন্দা হারিস উদ্দিন বলেন, একাত্তরে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সহযোগিতায় রাঙামাটিতে গণহত্যা চলে। এটা সবাই জানে। যারা পুরোনো তারা দেখেছে। কোনোদিন অনুতাপ পর্যন্ত দেখা যায়নি। আর তার সন্তানকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য করা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
দেবাশীষ রায় কেন, কোন যুক্তিতে ?
ত্রিদিব রায়ের স্ত্রী ছিলেন রাণী আরতি রায়। এই দম্পতির তিন পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। তার পুত্র দেবাশীষ রায় বর্তমানে চাকমা রাজা। তবে চাকমা সার্কেল চিফ হিসেবে দেবাশীষ রায়কে কোন যুক্তিতে সংবিধান সংস্কার কমিশনে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা নিয়ে জানতে চাইছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন মহল। অতীতে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি রক্ষায় দেবাশীষ রায়ের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।
সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষগুলোতে তার নীরব ভূমিকা পালন করা নিয়েও আছে নানা সমালোচনা। সর্বশেষ খাগড়াছড়ির পাহাড়ি-বাঙালি সংর্ঘষের ঘটনার রেশ ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটিতেও। মারা যান চার জন। এই ঘটনায় বরাবরই স্বার্থপর হয়ে দূরে থেকেছেন দেবাশীষ রায়। কথা বলেননি নিজের অবস্থান থেকে। নিশ্চুপ থেকেছেন আড়ালে। সমাধানে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি তাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী আর উপজাতি শব্দ নিয়ে বরাবরই রাজনীতি চলে আসছে বহুকাল ধরে। এই শব্দ দুটি নিয়েও দেবাশীষ রায়ের ভূমিকা রহস্যজনক। কখনও তিনি বলেছেন পাহাড়ে কোনো আদিবাসী নেই। যারা আছেন সবাই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। উপজাতি।
সমালোচিত আরেক নেতা সন্তু লারমার সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি একসসময় এই কথা বলার পর আবার নিজের অবস্থান বদলান। বলেন, পাহাড়ে আদিবাসীরাই এখানকার বাসিন্দা। উপজাতি বলে কিছু নেই। আমরা চাপিয়ে দেওয়া কোনো পরিচয় মানি না। আমরা উপজাতি নই, আদিবাসী। এ দাবি বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাবো
তার এই দ্বিমুখী আচরণের কথা তুলে ধরে ২০২০ সালে প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝারেন বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের পলাতক রাঙামাটির এমপি দীপঙ্কর তালুকদার।
কেবল তাই নয়, ২০১৮ সালে নেপালের কাঠমাণ্ডুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী সেমিনার আয়োজন করেছিলেন বলে নাম শোনা যায় ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের।
জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পাহাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখ ফুটিয়ে তুলতে তিনি কতটুকু সফল হয়েছেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন খোদ নিজের কমিউনিটির লোকজন।
সূত্র : পাহাড় সমুদ্র অনলাইন সংস্কার।